ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামের কোন বিধান পালনে শিথিলতার যেমন কোন অবকাশ নেই, তেমনি কোন বিষয়ে বাড়াবাড়িরও কোন সুযোগ নেই। প্রতিটি বিষয়ে রয়েছে ইসলামের সঠিক এবং সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা। অন্যান্য বিষয়ের মতো নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কেও রয়েছে কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা। সেসব বর্ণনা অনুযায়ী সঠিক আক্বীদা পোষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ তা‘আলা বহু সংখ্যক মাখলূক সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে তিন শ্রেণীর মাখলূক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হলো মাটির মানুষ, যার সম্মান বোঝানোর জন্য ফেরেশতা, জ্বিন ও ঐ সময়ের সকল মাখলূকের প্রতি আদেশ হয়েছিলো হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামকে সিজদা করতে। দ্বিতীয় মাখলূক নূরের তৈরি ফেরেশতা। তৃতীয় মাখলূক আগুনের তৈরি জ্বিন জাতি।
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিসের তৈরি, সে বিষয়েও কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা-বিশ্বাস হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম শ্রেণীর মাখলূক, তথা মাটির তৈরি মানুষ ছিলেন। তিনি নূরের বা আগুনের তৈরি ছিলেন না। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টিগতভাবে অন্যান্য মানুষের মতই মানুষ ছিলেন। আর লক্ষাধিক নবী-রাসূলসহ সকল মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছেন। তবে মানবিকতা এবং নীতি- নৈতিকতায় নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর উন্নত চরিত্র ও উত্তম আদর্শের ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَاِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِيم
অর্থ: নিশ্চয় আপনি চরিত্রের উচ্চতম স্তরে আছেন।
اللهَ وَ الْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًلَقَ ا
অর্থ: অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ; যারা আল্লাহ তা‘আলা ও শেষ দিবসের ব্যাপারে ভয় রাখে এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির করে।
যারা বলে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নূরের তৈরি ছিলেন, তারা কুরআনে কারীমের এই আয়াত দিয়ে প্রমাণ পেশ করার চেষ্টা করে,
قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ
অর্থ: অবশ্যই তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব।
তাদের দাবি হলো, উল্লিখিত আয়াতে ‘নূর’ শব্দ দ্বারা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বোঝানো হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি নূরের তৈরি না হতেন, তাহলে ‘নূর’ শব্দ দিয়ে তাঁকে কেন ব্যক্ত করা হলো? তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ এ আয়াতে ‘নূর’ ও ‘কিতাব’ দ্বারা একই বিষয় বোঝানো হয়েছে। এখানে নূরের ব্যাখ্যা হিসাবে ‘কিতাব’ শব্দটি আনা হয়েছে।
তার প্রমাণ হলো পরবর্তী আয়াত, يَهْدِي بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ
এখানে একবচন ব্যবহার করা হয়েছে। যদি ‘নূর’ দ্বারা ‘নবী’ উদ্দেশ্য হতো, তাহলে দ্বিবচন ব্যবহার করা হতো এবং বলা হতো يهدي بهما অর্থাৎ এ উভয়ের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে হেদায়াত দান করেন।
এরপরও যদি কোন মুফাসসির ‘নূর’ দ্বারা ‘নবী’কে উদ্দেশ্য করেন, সে ক্ষেত্রে আয়াতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘নূর’ বলার কারণ এই নয় যে, তিনি নূরের তৈরি ছিলেন। বরং তাঁকে এই অর্থে ‘নূর’ বলা হয়েছে যে, তিনি হেদায়াত ও মা’রিফাতের নূরে নূরান্বিত। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বারা মানব ও জ্বিন জাতিকে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন এবং তাদেরকে শিরক ও কুফরীর অন্ধকার থেকে বের করে ঈমানের নূর দান করেছেন।
কুরআন-সুন্নাহর যে সকল জায়গায় নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নূর বলা হয়েছে, সবখানে এই অর্থই উদ্দেশ্য। সেখানে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সৃষ্টিগত অবস্থা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। কারণ তাঁকে নূরের তৈরি বিশ্বাস করলে তাঁকে প্রথম শ্রেণীর মাখলূক থেকে নামিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর মাখলূক সাব্যস্ত করা হয়, যা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে স্পষ্ট বেয়াদবী। এর ফলে তাঁর সম্মান খাটো করা হয়। মাটির তৈরি বলা হলে তাঁকে অসম্মান করা হয় এ কথা সহীহ নয়; বরং এটা ইবলিস শয়তানের বিশ্বাস। এ কারণেই ইবলিস শয়তান, আল্লাহর স্রেষ্ট সৃষ্টি মাটির তৈরি হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামকে সিজদা করতে রাজি হয়নি।
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মাটির তৈরি মানুষ ছিলেন, তা কুরআনে কারীমে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও তা উম্মতকে বলে গেছেন। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحٰۤى اِلَيَّ اَنَّمَاۤ اِلٰهُكُمْ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ
অর্থ: (হে নবী!) আপনি বলুন, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। (তবে পার্থক্য হলো,) আমার প্রতি এই মর্মে ওহী অবতীর্ণ হয় যে, তোমাদের ইলাহ কেবলই একজন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
قُلْ سُبْحَانَ رَبِّيْ هَلْ كُنْتُ اِلَّا بَشَرًا رَّسُولًا
অর্থ: (হে নবী!) আপনি বলুন, আমার রব (আল্লাহ) পবিত্র। আমি কেবলই একজন মানব রাসূল।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِنْ قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِنْ مِتَّ فَهُمُ الْخَالِدُونَ
অর্থ: আপনার পূর্বেও কোন মানুষকে আমি অনন্ত জীবন দান করিনি। সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরঞ্জীব হবে?
সহীহ বুখারীতে হযরত আলকামা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামাযে ভুল হয়ে গেলো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! নামাযে কি নতুন কোন বিষয় ঘটেছে? নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কী হয়েছে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আপনি এভাবে এভাবে (অন্যান্য সময়ের তুলনায় ভিন্নভাবে) নামায পড়লেন! তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পা মুড়িয়ে কিবলামুখী হলেন এবং দু’টি সিজদা (সিজদায়ে সাহু) দিলেন। তারপর সালাম ফেরালেন।
অতঃপর আমাদের দিকে মুখ করে বসে বললেন,
إنه لو حدث في الصلاة شيء لنبأتكم به، ولكن إنما أنا بشر مثلكم، أنسى كما تنسون، فإذا نسيت فذكروني.
অর্থাৎ যদি নামাযে কোন নতুন বিষয় ঘটতো, তাহলে আমি তোমাদেরকে সে বিষয়ে অবহিত করতাম। কিন্তু আমি তো তোমাদেরই মত মানুষ। তোমরা যেমন ভুলে যাও, আমিও ভুলে যাই। সুতরাং আমি যদি (কোন কিছু) ভুলে যাই, তাহলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।’
সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত,
عن أبي هريرة يقول: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: اللهم إنما محمد بشر، يغضب كما يغضب البشر …
অর্থ: হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ তো শুধু একজন মানুষ। সে ক্রুদ্ধ হয়, যেমন অন্যান্য মানুষ ক্রুদ্ধ হয়…।
উপরোক্ত আয়াত এবং হাদীসসমূহে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘বাশার’ বলা হয়েছে। আর ‘বাশার’ শব্দের অর্থ হলো, রক্ত-গোশতে তৈরি সাধারণ মানুষ। তথাপি কুরআন-হাদীসে আছে, তিনি আমাদের মতই মানুষ। তবে তাঁর কাছে ওহী আসে, আর আমাদের কাছে ওহী আসে না। আর এটা সকলেরই জানা আছে যে, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। কাজেই আয়াত এবং সহীহ হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ হয়ে গেলো যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি মানুষ ছিলেন। নূরের তৈরি ছিলেন না। অর্থাৎ নূর শব্দের অর্থ হলো আলোক বা আলোকবর্তিকা। যেহেতু তিনি ছিলেন সকল উম্মতের জন্য হেদায়াতের আলোকবর্তিকা। আয়াত এবং হাদীসের যেখানেই তাঁকে ‘নূর’ বলা হয়েছে, সেখানে তাঁকে সকল জাতির হেদায়াতের কান্ডারী হিসেবে বিশেষণ অর্থে ‘নূর’বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যেরূপ ‘নুর’ শব্দের কর্তাবাচক শব্দ মুনীর বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, অনুরূপ বিশেষণ আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনের জন্য ব্যবহার করেছেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল, নাযিলকৃত অহী এবং সকল আসমানী কিতাব ‘নূর’; যা বান্দাদের প্রতি তাদের রবের পক্ষ থেকে আগমন করেছে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাকেই হিদায়াত করেন, যে তার সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, অর্থাৎ তার মনোনীত দ্বীনের আলোকে চলে। অতএব এ নূর হচ্ছে অহীর নূর। এর মাধ্যমে বান্দা তার রবের ইবাদাত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা লাভ করে। মানুষের সাথে সম্পর্কের নীতিমালা অর্জন করে। এ নুরই তার সঙ্গীতে পরিণত হয় এবং পথহারা অবস্থায় এ নুর দ্বারাই সে পথের সঠিক দিশা লাভ করে। মোদ্দাকথা নুর অর্থ অহী, এ অহী যেহেতু রাসূলের উপর নাযিল হয়েছে, তাই কখনো তাকে নূর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, কখনো কুরআনকে, কখনো তাওরাত ও ইঞ্জলকে। অতএব আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী সম্বলিত রাসূল ও স্পষ্ট কিতাব আগমন করেছে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সঠিক আক্বীদা পোষণ করার তাউফীক দান করুন। আমীন।
আরও পড়ুনঃ সন্ধ্যায় জানা যাবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী কবে
রেফারেন্সঃ
সূরা হা-মীম আস-সাজদাঃ আয়াত - ০৬
সূরা আল কাহফঃ আয়াত - ১১০
সূরা আল বাকারাঃ আয়াত - ১৫১
সূরা আশ-শূরাঃ আয়াত - ৫২
সূরা আল-আরাফঃ আয়াত - ১৫৭
সূরা আত-তাগাবুনঃ আয়াত - ৮
সূরা আন-নিসাঃ আয়াত - ১৭৪
সূরা আল-আনআমঃ আয়াত - ৯১
সূরা আল-মায়িদাহঃ আয়াত - ৪৪, ৪৬
No comments:
Post a Comment