চীনের সঙ্গে ব্যবসাসহ নানা কারণে যোগাযোগ থাকায় দেশটিতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেছেন, ইতোমধ্যে নেপাল ও থাইল্যান্ডেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়া গেছে। চীনের সাথে ব্যবসায়িক যোগাযোগ থাকায় বাংলাদেশও নতুন এই ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে আছে।
যার ফলে আমাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে। সকল জনগণকেও ভাইরাসের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এটা অবহেলা করার বিষয় নয়। আগামী এক মাসের মধ্যে ভাইরাসটি বাংলাদেশেও ছড়াতে পারে ধরে নিয়ে সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
সর্বপ্রথম চীনের উহান শহরে নিউমোনিয়া সদৃশ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যাও ২৬ থেকে বেড়ে ৪১ হয়েছে। চীনের ছাড়িয়ে নেপাল ও থাইল্যান্ড ছাড়াও ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির খোজ পাওয়া গেছে। এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে।
ভাইরাস ঠেকাতে নতুন চান্দ্রবর্ষ উদযাপনকে সামনে রেখে বাড়ি ফেরা মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার থেকে চীনের দশ টি শহরে গণপরিবহন ও আশপাশ এলাকাগুলোর সকল মন্দির বন্ধ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য ‘নিষিদ্ধ শহর’ ও গ্রেট ওয়ালের একটি অংশও বন্ধ করে রাখা হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। চীনা নববর্ষের সপ্তাহব্যাপী ছুটির মধ্যে দেশটির কোটি কোটি মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত করলে ভাইরাসটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশেও বিমানবন্দরে চীন ফেরতদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বিমানবন্দরে চীন থেকে আগমন করা ৯০০ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের কারও শরীরে এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি। এছাড়া আইইডিসিআরে আরও নয়জনকে পরীক্ষা করে কারও শরীরে এই ভাইরাস পাওয়া যায়নি। বিমানবন্দরে পরীক্ষাই করোনাভাইরাসে আক্রান্তকে চিহ্নিতে যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন দীর্ঘদিন চিকিৎসা গবেষণায় যুক্ত মুশতাক হোসেন। তার মতে, বিমানবন্দরের পরীক্ষায় অনেক সময় রোগটি ধরা নাও পড়তে পারে। এ কারণে চীন থেকে ফেরার পর কারও জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. মুশতাক সংবাদ প্রতিদিন বাংলাদেশ ডটকমকে বলেন, স্ক্রিনিংটা কোনো ফুল প্রুফ প্রক্রিয়া না। যদি জীবাণু নিয়ে আসে স্ক্রিনিং করার সময় তার জ্বর পাওয়া যাবে না। ১৪ দিনের মধ্যে যে কোনো সময় তার জ্বর হতে পারে। এ কারণে ফেরার কয়েক দিন পরও জ্বর হলে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করতে হবে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ রোগের জীবাণু ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে বলে হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় রুমাল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তাছাড়া সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাতমুখ ধোয়া এবং সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মুশতাক হোসেন। শারীরিকভাবে দুর্বল ও রোগাক্রান্তদের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, চীনে ইতোমধ্যে যারা মারা গেছে তাদের অধিকাংশই এই ভাইরাসের কারণে মারা যাননি। তারা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ কারণে যারা অসুস্থ তাদের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। উক্ত ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানিয়ে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি শনিবার সংবাদ প্রতিদিন বাংলাদেশ প্রতিবেদককে বলেন, বাংলাদেশে এখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তারপরও ভাইরাসটি নিয়ে প্রস্তুত থাকা খুবই জরুরি। বিভিন্ন দেশে এসব রোগী ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এটা শুধু উহান বা চীনে সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যে ভিয়েতনামে ১ জন রোগী পাওয়া গেছে, যে কখনও চীন ভ্রমণ করেননি। কিন্তু তার বাবা চীনে গিয়েছিল। এ কারণে অন্যান্য দেশেও রোগটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি। ডা. সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এখন পর্যন্ত ৯ জন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না জানতে আইইডিসিআরে এসেছেন। তাদের পরীক্ষা করে কারো ক্ষেত্রে পজিটিভ কোনও লক্ষণ পাওয়া যায়নি। এদের সবাই আবার চীন ফেরত না। অনেকের মধ্যে ভয় ছিল তারা জিজ্ঞেস করেছে। বিমানবন্দরে পরীক্ষা বিষয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, এই মুহূর্তে চীন থেকে আগমন করা যাত্রীদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। কারণ প্রাথমিকভাবে চীন থেকেই রোগটা বিস্তার লাভ করছে। সেই কারনে আমরা চীনকেই বেশি ফোকাস করেছি। চীনের কিছু লোকজন অন্য দেশের এয়ারলাইন্সে করে আসে যার মধ্যে হংকংয়ের এয়ারলাইন্সে আসা যাত্রীদেরও আমরা পরীক্ষা করছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা শ্বাসতন্ত্রের রোগের চিকিৎসায় অভ্যস্ত। এ ধরনের রোগীকে পেলে তাকে আলাদা করে রাখা বেশি জরুরী। বাংলাদেশের সকল জেলা হাসপাতালে রোগীকে আলাদা রাখতে বিশেষ ইউনিট চালু রয়েছে। সে সকল ইউনিটকে প্রস্তুত করে রাখার কাজ চলছে। সেগুলো অন্য কাজে ব্যবহৃত হত, এখন সেগুলোকে প্রস্তুত করে রাখতে আমরা কাজ করছি। কারণ কোনো রোগী পাওয়া গেলে তাকে আলাদা করে রাখতে হবে। রোগীরা যেন অন্যদের সংস্পর্শে না যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
No comments:
Post a Comment