বাংলাদেশ ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে, এখন যে ধরণের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে। এই পূর্বাভাস দিয়েছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে। বিবিসি বাংলার খবর।
শুক্রবার প্রকাশ করা হয় 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১' নামের এই রিপোর্টটি। এতে মূলত তারই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে সামনের বছর এবং আগামী ১৫ বছরে বিশ্বের কোন দেশের অর্থনীতি কী হারে বাড়বে। প্রতিবছর এই রিপোর্ট সিইবিআর প্রকাশ করে। আর মাত্র ৭ বছর পর পরেই এই রিপোর্ট অনুযায়ী চীন হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারত ২০৩০ সালে হবে তৃতীয়। আর বাংলাদেশের অবস্থান বহু ধাপ উপরে উঠে ২০৩৫ সাল নাগাদ ১৯৩টি দেশের মধ্যে পৌঁছে যাবে ২৫ নম্বরে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী। সিইবিআর বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনেক ওলট-পালট ঘটে গেছে। বেশিরভাগ বড় অর্থনীতির ইউরোপ-আমেরিকার দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। চীন খুব কৌশলে করোনাভাইরাস দ্রুত এবং কঠোরভাবে মোকাবেলার বিপরীতে সামনের বছরগুলোতে বেশ সুবিধেজনক অবস্থানে পৌঁছে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে চীন যে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে, সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছিল সেটাকে। কিন্তু সিইবিআর বলছে, এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে। আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, চীন যুক্তরাষ্ট্রকে তার থেকে ৫ বছর আগেই ২০২৮ সালে ছাড়িয়ে যাবে।
একইভাবে বাংলাদেশও যেহেতু চীনের মতোই করোনাভাইরাসের মধ্যেও কিছুটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে, তাই সামনের বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধারাবাহিক এবং জোরালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করছি সিইবিআর।
কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর আগের বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো ছিল সিইবিআর তাদের রিপোর্টে বলছে। এবং দেশটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও এটা ঘটেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা গত পাঁচ বছর ধরে বাড়ছে গড়ে ১ শতাংশ হারে।
কোভিড-১৯ বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যেভাবে ছড়িয়েছে, বাংলাদেশে সে তুলনায় সংক্রমণ অনেক সীমিত রাখা গেছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মারা গেছে ৭ হাজার ৫২ জন। প্রতি এক লাখে মাত্র ৪ জন। এই মহামারির কারণে যদিও বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ছিল সীমিত, তা সত্ত্বেও এটি অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে। কারণ বিশ্বজুড়ে মহামারির কারণে চাহিদা গিয়েছিল কমে আর আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
তবে অর্থনৈতিক মন্দা অন্য অনেক দেশে দেখা দিলেও বাংলাদেশ তা এড়াতে পেরেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালে হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
সিইবিআর এর পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২০২১ সাল হতে ২০২৫ সালের মধ্যে ঘটবে গড়ে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। তবে এর পরের দশ বছরে এই হার কিছুটা কমে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হবে।
সিইবিআর বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির সূচকে ২০২০ হতে ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আছে ৪১ নম্বরে। কিন্তু বাংলাদেশ ২০৩৫ সালে ২৫তম অর্থনৈতিক শক্তি হবে।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৩৯ ডলার। এই হিসেবটা পিপিপি বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটিকে হিসেবে নিয়ে করা। এখন একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বলে বাংলাদেশকে গণ্য করা হয়।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র সিইবিআর এর সূচক অনুযায়ী এখনো এক নম্বর শক্তি। এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে চীন এবং জাপান। প্রথম দশটি দেশের তালিকায় এরপর ক্রমান্বয়ে আছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা এবং কোরিয়া।
ইতালি, কানাডা এবং কোরিয়া ২০৩৫ সাল নাগাদ এই প্রথম দশটি দেশের তালিকা থেকে ঝরে যাবে। ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল এবং রাশিয়া তাদের স্থলে প্রথম দশটি দেশের তালিকায় ঢুকবে। বিশ্বের প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায় ২০৩৫ সাল নাগাদ যুক্ত হবে তিনটি নতুন দেশ: ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং বাংলাদেশ।
এর মধ্যে ভিয়েতনামের অবস্থান হবে ১৯, ফিলিপাইনের ২২ এবং বাংলাদেশের ২৫। বাংলাদেশের উত্থানকেই এর মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় বলতে হবে। বাংলাদেশ বহু দেশকে টপকে বর্তমান র্যাংকিং ৪১ থেকে পৌঁছাবে ২৫ নম্বরে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ৪১। বাংলাদেশের অবস্থান ২০২৫ সালে হবে ৩৪। এর পাঁচ বছর পর ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতি। প্রথম ২৫টি দেশের তালিকায় ঢুকবে ২০৩৫ সালে।
বাংলাদেশ যেসব অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে তার মধ্যে আছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, নরওয়ে, আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, নাইজেরিয়া, বেলজিয়াম, সুইডেন, ইরান এবং তাইওয়ান। এই দেশগুলো বর্তমান বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশের উপরে, কারণ বাংলাদেশের চেয়ে তাদের অর্থনীতি বড়।
আরও পড়ুনঃ টিএসসি ভবন ভেঙে ফেলা হবে, নতুন নকশার কাজ চলমান
তবে মনে রাখতে হবে, কেবলমাত্র কোন দেশের অর্থনীতির জিডিপির আকার দিয়ে এই সূচক তৈরি করা হয়। এখানে মানুষের মাথাপিছু আয় বা জীবনমান বিবেচ্য বিষয় নয়। আর যেহেতু বাংলাদেশ খুবই জনবহুল একটি দেশ এবং জনসংখ্যা ২০৩৫ সাল নাগাদ আরও বাড়বে, তাই অনেক দিক থেকেই পেছন ফেলে যাওয়া দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানে তখনো অনেক পার্থক্য থাকবে।
No comments:
Post a Comment